৭৩০ দিনের আগ্রাসন: গাজায় ক্ষুধা, মৃত্যু আর ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। আগামীকাল মঙ্গলবার সেই আগ্রাসনের দুই বছর পূর্ণ হবে। এই দুই বছরে গাজায় নিহত হয়েছে ৬৭ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার। এ সময়ের মধ্যে ইসরায়েল প্রায় দুই লাখ টন বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেছে উপত্যকাটিতে।

লেবাননের সংবাদমাধ্যম আল–মায়েদিন জানিয়েছে, গাজার সরকারি জনসংযোগ কার্যালয় আগ্রাসনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, চলমান হামলায় গাজা এখন ভয়াবহ ধ্বংস, গণহত্যা, এবং মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং অসংখ্য পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৭৬,৬০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত বা নিখোঁজ। এর মধ্যে ৬৭,১৩৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। প্রায় ৯,৫০০ জন এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিহতদের অর্ধেকের বেশি নারী, শিশু ও প্রবীণ—এর মধ্যে ২০ হাজার শিশু ও ১২ হাজার ৫০০ নারী।

গাজার অবকাঠামোর ৯০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই বছরে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেককে একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েল গাজায় “ক্ষুধা ও জাতিগত নিধনের নীতি” অনুসরণ করছে।

এই সময়ে ৩৮টি হাসপাতাল ও ৯৬টি ক্লিনিক ধ্বংস হয়েছে বা অচল হয়ে পড়েছে। ১৯৭টি অ্যাম্বুলেন্সে হামলা হয়েছে, নিহত হয়েছেন ১,৬০০-এর বেশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, ২৫৪ সাংবাদিক, ১৪০ সিভিল ডিফেন্স সদস্য এবং ৫৪০ মানবিক সহায়তাকর্মী।

১,৬৯,০০০-এর বেশি মানুষ আহত হয়েছে, কিন্তু গাজায় চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা নেই। বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি পাওয়া ২২,০০০ রোগী এখনো গাজার ভেতরেই আটকে আছেন। ৬,৫০,০০০ শিশু মারাত্মক খাদ্যসংকটে ভুগছে—দুধ, ওষুধ ও খাবারের তীব্র অভাবে জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার প্রায় সব মানুষ এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল এবং তারা “অভূতপূর্ব বঞ্চনার শিকার।” ৯৫ শতাংশ বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত, ১৬৫টি সম্পূর্ণ ধ্বংস। নিহত হয়েছে ১৩,৫০০ শিক্ষার্থী, ৮৩০ শিক্ষক ও ২০০ গবেষক। ধর্মীয় স্থানগুলোও রেহাই পায়নি—৮৩৫টি মসজিদ ধ্বংস, কয়েকটি গির্জা ক্ষতিগ্রস্ত এবং এমনকি কবরস্থানও ধ্বংস করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গাজার ১৫টি খাতে সরাসরি ক্ষতির পরিমাণ ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আবাসন খাতে ২৮ বিলিয়ন, স্বাস্থ্য খাতে ৫ বিলিয়ন এবং শিক্ষা খাতে ৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। কৃষি ও মৎস্য খাত প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর দীর্ঘমেয়াদি হুমকি তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনের শেষ অংশে আন্তর্জাতিক সমাজকে আহ্বান জানানো হয়েছে—গাজা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নিতে হবে। অবরোধ তুলে দিয়ে সীমাহীন মানবিক সহায়তার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বারবার আহ্বানের পরও নিরাপত্তা পরিষদে রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।

দুই বছর পেরিয়ে তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছে যুদ্ধ। গাজা এখন প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত, যেখানে মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ একে বলছে—“৭৩০ দিনের গণহত্যা ও জাতিগত নিধন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *